সাদিক ভেবেছে আজ সে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়বে। কিন্তু কিছুক্ষণ পড়েই সে ভাবলো, এখন একটু বিরতি নেওয়া দরকার, অনেকতো পড়েছি। তাই, ১০ মিনিট বিরতি নিয়ে সে আবার পড়া শুরু করবে। ব্যস! বিরতির অজুহাতে সে চলে গেলো ফেসবুকের দুনিয়ায়। ওমা! কখন যে সময় ফুঁড়িয়ে মিনিটকে পিছনে ফেলে ঘন্টার কাটাকে ছুঁয়ে ফেলেছে, সে বিন্দুমাত্র টের পায়নি। আর এই গল্পটি শুধু সাদিকের নয়। আমার-আপনার মতো অনেকেরই প্রত্যেহ গল্পের একাংশ বলা চলে। আর এভাবেই কাজের ফাঁকে, ট্রাফিক জ্যামে বা যেকোনো অবসরেই আমরা ফোনের টুং-টাং নোটিফিকেশনে সঙ্গী করে নেই ফেসবুককে।
লাইক, কমেন্ট, স্ট্যাটাস, শেয়ার এই শব্দ এর প্রতি আকৃষ্ট নেই এমন ব্যক্তির সংখ্যা বর্তমান যুগে কমই মেলে। কারণ, আমরা মানসিক প্রশান্তি বা অবসরে বিনোদনের খোঁজেই হয়ে পড়ি ফেসবুকের নীল আকাশের সাদা গাঙচিল। কিন্তু, আমরা অনেকেই হয়তো জানি না ক্ষণিকের এই বিনোদন জগৎ আমাদের ‘মানসিক বিষণ্ণতার’ একটি উৎস। কি অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, ফেসবুক কীভাবে আবার মানসিক বিষণ্ণতার কারণ হয়? ব্যাপারটা কিন্তু আসলেই তাই। তবে না হয় আপনি নিজেই দেখে নিন ফেসবুক যেভাবে হয়ে ওঠে মানসিক বিষণ্ণতার কারণ।
Contents
ফেসবুক
উল্কার বেগে জনপ্রিয়তা পেয়েছে ফেসবুক। তার পেছনে কারণেরও শেষ নেই। যেমন: সুদূর বিদেশে আপনার কোনো আত্মীয় বা স্কুল বদলের কারণে হারিয়ে ফেলা কোনো বন্ধু এবং জানাশোনা পরিচিতজনদের সাথে যোগাযোগ করা যাচ্ছে নিমিষেই। পোস্টকার্ডের আর কোনো খরচের দরকার হয় না। সেই বিদেশি আত্মীয়ের মেয়ে সকালে কী খেয়েছে বা সেই পুরানো বন্ধুর কুকুরটা নতুন কী কাণ্ড করল – একটি ক্লিকেই সব জানা যাচ্ছে।
আপনি লক্ষ্য করলেই দেখবেন আপনার পরিবারের ছোট্ট সদস্যটিও কিছুটা হলেও ফেসবুকের প্রতি আসক্ত। আর এভাবেই ফেসবুক জনপ্রিয়তায় আমরাও ফেসবুক আসক্ত হয়ে পড়ছি। তবে জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রের সুবিধা-উপকারের মতোই এক্ষেত্রেও দিতে হয় কিছু অদৃশ্য মানসিক মূল্য। একটি বিষদ গবেষণায় দেখা গেছে, খুব বেশি ফেসবুক ব্যবহারকারীদের বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা আর বিচার ক্ষমতা সময়ের সাথে সাথে কমে যায়। শুধু তাই নয়, এর সাথে আরো কিছু মানসিক সমস্যাতো রয়েছেই।
ফেসবুক আসক্তি
চা, সিগারেট, মদ সমাজের মানুষের অন্যতম আসক্তি হিসেবে ধরা হলেও সম্প্রতি DSM-V (Diagnostic and Statistical Manual) বিতর্কিত এক নতুন আসক্তি তালিকায় যুক্ত হয়েছে- ‘ইন্টারনেট আসক্তি’। এর মধ্যে ফেসবুক আসক্তি মিডিয়া নিউজের কল্যাণে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। গবেষক হফম্যান এবং তার সহকর্মীরা বাছাইহীনভাবে অনেককে ম্যাসেজ দিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, ‘কোনটি ছাড়া একদিনও চলবে না?’ দেখা গেছে, সিগারেট বা কোনো মাদকদ্রব্যের চেয়ে যে উত্তরটি বেশি এসেছে তা হলো, ‘সোশ্যাল মিডিয়া, বিশেষ করে ফেসবুক’। আর এই অতিরিক্ত আসক্তির ফলে দেখা দেয় নিম্নোক্ত উপসর্গগুলো। তাই নিজেকে লক্ষ্য করুন আর মিলিয়ে নিন উপসর্গগুলো। যদি আপনার সাথে মিলে যায়, তাহলে দুঃখজনক হলেও এটাই সত্যি আপনিও ফেসবুক অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার (Facebook Addiction Disorder) বা “ ফেসবুক আসক্তি সংকটে”– আসক্ত হয়ে পড়েছেন। যেমন:
- বিষণ্ণতা
- অস্থিরতা
- নিজেকে হীনমন্য মনে করা
- চঞ্চলতা বৃদ্ধি পাওয়া
- অল্পতে ভয় পাওয়া
- অল্পতে রেগে যাওয়া
- অহেতুক সন্দেহ করা
- ঘুম ও খাওয়া-দাওয়ায় পরিবর্তন আসা
- প্রচন্ড মাথা ব্যাথা, ইত্যাদি।
এছাড়াও মন খারাপ হলে অনেকে ফেসবুকে গিয়ে সুখ খোঁজেন। কিন্তু অতিরিক্ত সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহার করলে সুখ পাওয়া যায় না বরং বাড়ে আরো দুঃখ। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতিরিক্ত সময় ধরে ফেসবুক ব্যবহারে দুঃখ যেমন বাড়ে, তেমনি এটি স্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় ও ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা, ফেসবুক ব্যবহারের ধরণ নিয়ে গবেষণা করেন। ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৫ হাজার ২০৮ জনের ওপর ফেসবুক ব্যবহারের ধরণ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ফেসবুকের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের নেতিবাচক সম্পর্ক দেখা গেছে। যে দিকগুলো আরো বেশি প্রভাব ফেলছে তা হলো:
আমার জীবন অন্যদের মতো ভাল নয়
সমাজ বিষয়ক মনস্তাত্ত্বিক লিওন ফেস্টিঞ্জার দেখেছেন, সহজাতভাবেই অন্যের সাথে সামাজিক অবস্থানের তুলনার ঝোঁক রয়েছে মানুষের মধ্যে। ‘আমার গড়পড়তা অন্য সবার চেয়ে ভাল না খারাপ?’ – এই প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেছে মানুষ নিজেদের সাথে অন্য কারো তুলনা করা শুরু করে দিচ্ছে। আর বিনা পরিশ্রমে এই তুলনার ভালো একটি মাধ্যম ফেসবুক।
ফেসবুক নিউজফিডেই দেখা মেলে কোনো বন্ধুর বড় কোনো রেস্তোরাতে খাবার ছবি বা হয়তো পেশাগত পদক পাওয়ার ছবি বা চাকরিতে পদোন্নতি। নয়তো, নতুন গাড়ি কেনার খবর বা সেন্টমার্টিন অথবা বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার খবর। মোবাইলের ঝলমলে স্ক্রিনে এসব দেখতে দেখতে তখন মনে হয় সবাই হয়তো ভালোভাবে জীবন পার করছে। আমার প্রতিই ভাগ্য এতোটা নিষ্ঠুর। ওরা এতো ভালো অবস্থানে আছে, এতো জায়গাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ‘আমি’ কিছুই করতে পারছি না! এভাবেই মনের অজান্তে দীর্ঘদিন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে নিজের সম্পর্কে ভুল ধারণা গড়ে ওঠে। আর তখনই মনের গহীনে শুরু হয় বিষণ্ণতা-হতাশার আনাগোনা।
সঙ্গীর প্রতি ঈর্ষাপরায়ণতা
আমরা অনেক সময় বলে থাকি, ভালোবাসায় সবকিছুর মাঝে একটু ‘জেলাসি’ তো থাকবেই। আর এই একটু একটু থেকেই যখন বড় আকারে রূপ নেয় ঠিক তখনই দেখা দেয় নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য। অতঃপর আরকি! শুরু হয় মানসিক বিষণ্ণতা। আবার, সঙ্গীর স্ট্যাটাস বা ছবিতে তার কোনো প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকা বা বিপরীত লিঙ্গের অন্য কেউ মাঝে মাঝেই লাইক বা লাভ রিয়েক্ট দিচ্ছে বা কমেন্ট করছে। তার সঙ্গীও হয়তো আন্তরিকভাবেই প্রতিউত্তর করছে বা কারো সাথে বেশি যোগাযোগ করছে। এই বিষয়গুলো যে কোনো ফেসবুক ব্যবহারকারীর মনে তার সঙ্গীর জন্য ঈর্ষাপরায়ণতার সৃষ্টি করে দিতে পারে। ‘ফেসবুক এন্ড ইওর ম্যারিজ’ এর লেখিকা ক্রাফস্কি বলেন, দাম্পত্য জীবন বা প্রেমঘটিত সম্পর্কের অনেক সমস্যাই আজকাল কারণ হিসেবে ফেসবুক ব্যবহারকে বলা যায়।
ব্যক্তিজীবনের অপ্রয়োজনীয় কিছু কার্যক্রম
বন্ধুদের সাথে চায়ের আড্ডা, পারিবারিক আড্ডা, বা হোক না সারাদিনের কর্ম-ব্যস্ততার পরে আপনার প্রিয় মানুষটির যখন প্রয়োজন ‘আপনাকে’; ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে আমরা অনেকেই পড়ে থাকি সোশ্যাল মিডিয়ার জগতে। আর এভাবেই আমরা নষ্ট করে ফেলি আমাদের ভালো কিছু মূহুর্ত এবং সম্পর্ক। আবার অনেক ক্ষেত্রে, কোনো সম্পর্কের শেষ পরিণতি ঘটে একজন অপরজনের ব্লকের তালিকায়। পরক্ষণেই হাজারো প্রশ্নের সমাহারে, মানসিক উদগ্রীবতায় অনেকেই শরণাপন্ন হয়ে পড়ি ফেক-আইডির। আর এভাবেই শুধু শুধু বাড়ে মানসিক অশান্তি। শুধু তাই নয় দেখা গেছে, সম্পর্ক বিচ্ছেদের পর নিজের প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকা বা স্বামী বা স্ত্রীর সাথে সরাসরি কথা বলার চেয়ে ফেসবুকে মাঝে মাঝে তার ওয়ালে যাওয়া, কারো মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর।
ফেসবুকের ব্যবহার কমাবেন কিভাবে
- বন্ধু সংখ্যা সীমিত রাখুন । সখ্য সংখ্যা সময় কেড়ে নেয়, কিন্তু আপনাকে অগভীর করে তোলে । “You paying for quantity, but quality is what you spend for.” – Wiz Khalifa
- তাদেরকেই বন্ধু লিস্টে রাখুন, যাদের লেখা থেকে কিছু শিখতে পারেন, শিখতে পারবেন । যাদের লেখা পড়লে ভাবার কিছু পাওয়া যায়, কিছু ভাবতে পারেন । একজন ভালো বন্ধুর লেখা আপনার প্রিয় পত্রিকার মতো । একজন ভালো বন্ধুর কথা বালিশের কাছে প্রিয় বইটির মতো । “Life is partly what we make it, and partly what it is made by the friends we choose.” – Tennessee Williams
- সেলিব্রিটিদের আনফলো করুন । ওনারা প্রাপ্ত বয়স্ক দেহে শিশু মস্তিষ্ক । আপনার মস্তিষ্ককে বিষক্রিয়া করতে একজন সেলিব্রিটিই যথেষ্ট । “What’s the whole point of being pretty on the outside when you’re so ugly on the inside?” – Jess C. Scott
- গ্রুপ সংখ্যা কমিয়ে আনুন । বিষয়ভিত্তিক কোনো বিষয় নিজের ভালো লাগা হলে এবং সেখানে সে বিষয়ের কিছু দক্ষ মানুষের লেখা দেখলে, কেবল সেগুলোতে অ্যাড হবেন । নিজের লেখা শেয়ার করতে ভালো লাগা গ্রুপে অ্যাড হবেন, কিন্তু আনফলো রাখবেন, যাতে গ্রুপের আবর্জনা লেখা আপনার নিউজফিডে না আসে । বেশিরভাগ গ্রুপ হলো গরুর হাট । “There are two kinds of people, those who do the work and those who take the credit. Try to be in the first group; there is less competition there.” – Indira Gandhi
- পরিবার বা পরিচিত যাদের লেখা দেখলে বিরক্ত লাগে কিন্তু অ্যানফ্রেন্ড করলে ভেজাল করে, তাদের অ্যানফ্রেন্ড না করে আনফলো করবেন । সাপ মরবে, লাঠি ভাঙবে না । “Love them but don’t be part of their drama.” – Samuel Zulu.
- পেইজ লাইক একেবারেই অপ্রয়োজনীয় । পেইজ বাদ দেবেন লাইক দেয়া থেকে । পেইজ হলো সেলিব্রিটিদের পয়সা খরচ করে আপনাকে আবর্জনা খাওয়ানোর বুষ্ট আপ করা বিজ্ঞাপন । ফেসবুকে পেইজ’ই একমাত্র বিজ্ঞাপন বুস্ট আপ করা যায় । “Social media is an advertisement for the superficial extroverted self.” – Hozier
- পত্রিকাগুলো আনফলো করবেন । দেশি পত্রিকাগুলো হলো জাতীয় আবর্জনার ভাগাড় । পড়লে বিদেশী কিছু রেপুটেবেল পত্রিকা পড়বেন । দেশি পত্রিকা গুলো পড়লেও যা জানবেন, না পড়লেও একই থাকবেন । “Journalism is just a gun. It’s only got one bullet in it, but if you aim right, that’s all you need. Aim it right, and you can blow a kneecap off the world.” – Warren Ellis
- ফেসবুকের লাইভ দেখে সময় নষ্ট করবেন না । লাইভ হল চানাচুর, যতক্ষণ খাবেন, ততক্ষন মজা পাবেন ! কাজের কাজ শরীরের কিছু হবে না । বেশিরভাগ লাইভকারী : “কাজীর গরু কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই ।” – প্রবাদ
- ফেসবুকের ভিডিওগুলো দেখবেন কম । রান্না বা দৈনন্দিন কোনো টিপস জাতীয় লাইফ হ্যাক কিংবা ক্রিয়েটিভ কোনো ভিডিও থাকলে দেখবেন সে গুলো । কিভাবে জীবনটাকে সহজ করা যায়, সময় সেদিকে দেবেন । কারো ভিডিও ভ্লগগুলোতে দেখার কিছু নেই, ওসব তাদের দৈনন্দিন অপকর্মের তালিকা । “Everyone has their opinions but don’t let it affect your dream.” – Unknown
- ফেসবুককে ব্যবহার করবেন বিকেলে একটু পাড়া ঘোরার মতো । এর চেয়ে বেশি করলে সারাদিন পাড়া ঘুরে যে লাভ, ওই একটুকরো বিকেলে ঘুরে একই লাভের চেয়ে বেশি কিছু পাবেন না । বিনিময়ে কেবল সময় নষ্ট করবেন । মনে রাখবেন, ফেসবুক আপনার এই সময় বিক্রি করে বছরে একশো বিলিয়ন ডলারের বেশি কামায়, কিন্তু আপনার পকেটে কিছু আসে না।
পরিশেষে
এভাবে যতো যাই বলা হোক না কেন বর্তমানে আমরা কেউ পারবো না প্রযুক্তির একটি উদ্ভাবনকে এড়িয়ে জীবন চালাতে। তাই ফেসবুকও ব্যবহার করতে হবে, তবে সেটা পর্যাপ্ত পরিমাণে। যেমন ধরুন, অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ যেমন স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ঠিক তেমনি কম খাওয়াও। তাই আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে বেশি গুরুত্ব দিতে গিয়ে বাস্তবতায় হয়ে পড়ছি অসামাজিক। তাই বিষণ্ণতা বা অবসরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়, সময় দিন আপনার সামাজিক জীবনে আর গড়ে তুলুন বিষণ্ণতামুক্ত সুন্দর একটি জীবন।